পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে এখন মানুষ আর ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে না। দিন-রাত কারখানা নদীর গর্জন শুনে আতঙ্কে কাটে সময়। যে নদী একদিন জীবন দিয়েছিল, সেই নদী আজ যেন ক্ষুধার্ত দানবের মতো একের পর এক গ্রাম গিলে খাচ্ছে। একসময় যেখানে ফসলের মাঠ, পুকুরে মাছ আর উঠোনভরা হাসির শব্দ ছিল—আজ সেখানে শুধু হাহাকার, ভাঙা ঘর আর কান্নার সুর।
কাছিপাড়া ইউনিয়নের হাজিপুর গ্রামের আলেয়া বেগম (৫৫) এখন নিজের পরিচয়ই খুঁজে পান না। বিয়ের সময় যে ঘরে এসেছিলেন, গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান আর উর্বর জমির যে স্বপ্ন ছিল—সবই আজ নদীর গর্ভে। চোখের সামনে তাঁর একের পর এক স্বপ্ন ডুবে গেছে করখানার পেটে। কথা বলতে বলতে আলেয়ার গলা কেঁপে ওঠে, বলেন, ‘এই নদী আমার সব কিছু খাইয়া ফেলছে। স্বামীর ঘর, জমি—কিছুই রাখে নাই। শুধু আমি না, হাজিপুর গ্রামটাই নাই এখন। যে জমিগুলা ছিল, সেগুলা পাশের উপজেলায় চর হয়ে বড়লোকরা ভোগ করতাছে।’
তিনবার নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়া আলেয়া এখন দুই সন্তান নিয়ে কাছিপাড়া সড়কের পাশে খড় আর টিনের একচালা ঘরে থাকেন। মাথার ওপর নিরাপদ ছাদ বলতে কিছুই নেই; ঝড় বা বৃষ্টি এলে প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আতঙ্কে। কবে আবার নদী তার শেষ আশ্রয়টুকু কেড়ে নেয়—এই চিন্তায় তাঁর রাতের ঘুম নেই।
নদীর ভয়াল ছোবল আলেয়ার মতো অসংখ্য প্রাণে হাহাকার ডেকে এনেছে। গোপালিয়া বাঘা গ্রামের কৃষক আয়নাল হোসেনের গল্প আরও মর্মান্তিক। নিজের চোখের সামনে বড় ভাইকে হারিয়েছেন নদীর গিলে খাওয়ায়। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, ‘বর্গা জমির ধান কাইটা আনমু, এইটাই ছিল পরিকল্পনা। আমি আগে আসছি, ভাই আর আসেনি। পরে দেখি ধানের আঁটি ভাসতাছে… ভাই মাটির নিচে চাপা পড়া গেছে।’ তাঁর চোখে তখনও সেই দিনের ভয় লুকিয়ে।
কাছিপাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ইয়াকুব আলী রুবেল মোল্লা জানান, তেঁতুলিয়া নদী থেকে শুরু হয়ে বাকেরগঞ্জের গোমা হয়ে কারখানা-ঝিলনা নদী লোহালিয়া হয়ে পায়রায় মিলেছে। কিন্তু এই নদী এখন আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে কাছিপাড়া, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়নের মানুষের জন্য। তাঁর ভাষায়, ‘বর্তমানে বাহের চর, হাজিরপুর, গোপালিয়া, কলতা, সন্ন্যাসীকান্দার মতো গ্রামগুলো একেবারেই অরক্ষিত। কোথাও বেড়িবাঁধ নেই। ভাঙন আর জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর মানুষ সব হারাচ্ছে। হাজিপুর গ্রাম তো পুরোপুরি নদীর পেটে চলে গেছে।’
এখন শুধু ঘরবাড়িই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ঝুঁকিতে। চররঘুনাদ্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হিস্যাজাত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উত্তর কাছিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে। হিস্যাজাত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এফ এম মামুন হোসেন বলেন, ‘আমি আসার সময় নদী ছিল অনেক দূরে। এখন মাত্র দেড়শ মিটার দূরে এসে গেছে। জোয়ার এলেই আতঙ্কিত হয়ে ছুটি দিতে হয়। পানির গর্জন শুনলেই মনে হয় এই বুঝি স্কুলটাও ভেসে যাবে।’
বাউফল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, নদীর প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাঁর কথায়, ‘গ্রাম বাঁচাতে দ্রুত বাঁধ নির্মাণ বা 자িও ব্যাগ ফেলা প্রয়োজন।’
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব জানান, বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত বরাদ্দ এখনো নেই। তবে জরুরি ভিত্তিতে ৮০ লাখ টাকার জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে। অনুমোদন মিললে ব্লক ও জিও ব্যাগের মাধ্যমে নদীশাসনের কাজ শুরু হবে।
তবে মানুষ আর আশ্বাসে বাঁচতে পারছে না। প্রতিদিন নদীর বুকে বিলীন হচ্ছে নতুন নতুন ভূমি। রাত নামলেই বুকের ভেতর ভয় চেপে বসে—এই বুঝি সব শেষ হয়ে যায়। ভাঙন যদি দ্রুত ঠেকানো না যায়, তবে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে বাউফলের আরও কয়েকটি গ্রাম।
নদী আজ এখানে প্রকৃতির নয়—নির্মমতার আরেক নাম।