আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পটুয়াখালী জেলার বিখ্যাত খাবার। পটুয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপকূলীয় ও নদীবিধৌত জনপদ। নদী, সাগর, চরাঞ্চল ও গ্রামীণ জীবনধারার প্রভাব এ জেলার খাদ্যসংস্কৃতিকে করেছে বৈচিত্র্যময় ও স্বতন্ত্র। এখানকার খাবারে যেমন আছে কৃষিনির্ভর ঐতিহ্য, তেমনি আছে নদী ও সাগরকেন্দ্রিক খাদ্যাভ্যাসের সুস্পষ্ট ছাপ।
পটুয়াখালীর খাদ্যসংস্কৃতি মূলত তিনটি ধারায় গড়ে উঠেছে—
১) দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য
২) মাছ ও সামুদ্রিক খাবার
৩) গ্রামীণ ও উৎসবকেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাহী রান্না
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও পরিচিত খাবার হলো মহিষের দই, যা স্থানীয়ভাবে ভৈষা দই নামে পরিচিত।

ঐতিহ্যবাহী মহিষের দই (ভৈষা দই)
পটুয়াখালী জেলার উল্লেখযোগ্য খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো ঐতিহ্যবাহী মহিষের দই। স্থানীয়ভাবে এই দই ভৈষা দই নামে পরিচিত। উৎসব-পার্বণ, পারিবারিক অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে এই দইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এই খাদ্যের প্রচলন শুরু হয় প্রায় দুইশ’ বছর আগে, যখন ভোলা ও পটুয়াখালী সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ মহিষ পালনের মাধ্যমে দুধ সংগ্রহ শুরু করে। মূলত চরাঞ্চল ও লবণাক্ত জমিতে গরুর তুলনায় মহিষ বেশি উপযোগী হওয়ায় এ অঞ্চলে মহিষ পালন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে মহিষের দুধ থেকে তৈরি কাঁচা দইও ধীরে ধীরে একটি আলাদা পরিচিতি লাভ করে।
ব্রিটিশ আমল থেকেই এই দইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তখন নৌপথে ব্যবসা ও যোগাযোগের সুবাদে পটুয়াখালী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মহিষের দই বিভিন্ন হাট-বাজার ও শহরে পৌঁছাতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মহিষের দইয়ের বৈশিষ্ট্য
মহিষের দুধের দই সাধারণ গরুর দইয়ের তুলনায়—
- বেশি ঘন ও ক্রীমযুক্ত
- স্বাদে হালকা টক
- পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ
- দীর্ঘ সময় ভালো থাকে
এই দই সাধারণত কাঁচা টক দই হিসেবেই খাওয়া হয়। তবে খাওয়ার ধরনে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। এটি শুধু গুড়, মিষ্টি বা চিনি দিয়ে খাওয়া হয় না, বরং—
- মুড়ি
- চিড়া
- খই
এর সঙ্গেও সমান জনপ্রিয়ভাবে পরিবেশন করা হয়। গ্রামবাংলায় সকালের নাশতা কিংবা দুপুরের হালকা খাবার হিসেবে এই সংমিশ্রণ অত্যন্ত পরিচিত।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
প্রায় দুই’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই দই পটুয়াখালী অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম প্রধান উপাদান। গ্রামে কোনো সম্মানিত অতিথি এলে ভৈষা দই পরিবেশন করা সৌজন্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া—
- বিয়ে
- আকিকা
- মিলাদ
- ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব
এসব অনুষ্ঠানে মহিষের দই বিশেষ মর্যাদা পায়।
যদিও ভোলা জেলা মহিষের দইয়ের একটি বড় ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত, তবে পটুয়াখালী ও ভোলা—এই দুই জেলার খাদ্যসংস্কৃতি ঐতিহাসিকভাবে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ফলে পটুয়াখালী জেলার মানুষের খাদ্যতালিকায়ও ভৈষা দই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
মাছ ও সামুদ্রিক খাবার
পটুয়াখালী জেলা নদী, খাল, বিল ও বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন হওয়ায় এ জেলার খাদ্যসংস্কৃতিতে মাছের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার মানুষের প্রধান আমিষের উৎস মাছ। নদী ও সাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় পটুয়াখালী জেলাকে ইলিশের অন্যতম স্বর্গরাজ্য বলা হয়।
ইলিশ মাছ
পটুয়াখালী জেলার নদী মোহনা ও উপকূলীয় এলাকায় ধরা পড়া ইলিশ মাছ স্বাদে ও গুণে অতুলনীয়। বিশেষ করে পায়রা নদী, লোহালিয়া নদী ও তেঁতুলিয়া নদীর ইলিশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিখ্যাত।
ইলিশ দিয়ে তৈরি কিছু জনপ্রিয় খাবার হলো—
- ভাপা ইলিশ
- ইলিশ ভুনা
- ইলিশের পাতুরি
- সরিষা ইলিশ
- ইলিশের টক ঝোল
বর্ষা মৌসুমে ইলিশ প্রায় প্রতিটি পরিবারের খাবারের তালিকায় থাকে। সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে ইলিশ পরিবেশন করা সম্মানের বিষয় হিসেবে ধরা হয়।
শুঁটকি ও শুকনো মাছ
উপকূলীয় জেলা হওয়ায় পটুয়াখালীতে শুঁটকি মাছ একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাদ্য। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও উপকূলবর্তী এলাকায় শুঁটকি প্রস্তুত করা হয় প্রাকৃতিক উপায়ে।
বিখ্যাত শুঁটকি মাছের মধ্যে রয়েছে—
- লইট্টা শুঁটকি
- চিংড়ি শুঁটকি
- ফাইসা শুঁটকি
- রূপচাঁদা শুঁটকি
শুঁটকি দিয়ে তৈরি ভুনা, ঝাল ও ভর্তা পটুয়াখালীর মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। অনেক পরিবারে অতিথি আপ্যায়নে শুঁটকি ভুনা বিশেষ পদ হিসেবে পরিবেশন করা হয়।
চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছ
পটুয়াখালী জেলার উপকূল ও নদী এলাকায় প্রচুর চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। গলদা ও বাগদা চিংড়ি এখানকার জনপ্রিয় মাছ। এসব মাছ দিয়ে তৈরি—
- চিংড়ি মালাইকারি
- চিংড়ি ভুনা
-
চিংড়ি দিয়ে ডাল
এগুলো স্থানীয়ভাবে খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছ যেমন লাক্ষা, রূপচাঁদা, পোমফ্রেট, কোরাল মাছ পটুয়াখালীর বাজারে সহজলভ্য এবং খাদ্যসংস্কৃতির অংশ।
গ্রামীণ ও ঘরোয়া রান্না
পটুয়াখালীর গ্রামীণ জীবনে ঘরোয়া রান্নার একটি আলাদা স্বাদ ও ঐতিহ্য রয়েছে। এখানে সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করা হয়।
বিখ্যাত গ্রামীণ খাবারের মধ্যে রয়েছে—
- শাক-সবজির ভর্তা (পুঁই শাক, লাল শাক, কলমি শাক)
- আলু ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা
- ডাল ও ভাজি
- কচু শাক ও কচু মুখি
এ অঞ্চলে রান্নায় সরিষার তেল ও দেশি মসলা ব্যবহারের প্রবণতা বেশি, যা খাবারে আলাদা সুগন্ধ ও স্বাদ যোগ করে।
উৎসব ও মৌসুমি খাবার
পটুয়াখালী জেলার খাদ্যসংস্কৃতি শুধু দৈনন্দিন খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং ঋতুভিত্তিক ও উৎসবকেন্দ্রিক খাবার এখানকার মানুষের জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নবান্ন ও ফসল উৎসবের খাবার
ধান কাটার মৌসুমে গ্রামে গ্রামে নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হয়। এ সময় নতুন চালের ভাত দিয়ে বিশেষ কিছু খাবার রান্না করা হয়, যেমন—
- নতুন চালের ভাত
- দেশি মুরগির ঝোল
- শাক-সবজি ও ডাল
- মাছ ভাজা বা ঝোল
নবান্ন উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের একসঙ্গে খাওয়ানোর রীতি এখনো অনেক এলাকায় প্রচলিত।
পিঠা-পুলি ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন
শীতকাল এলেই পটুয়াখালী জেলার ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা উৎসব। চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড় ও নারকেল ব্যবহার করে তৈরি এসব পিঠা শুধু খাবার নয়, বরং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক।
বিখ্যাত পিঠাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- চিতই পিঠা
- ভাপা পিঠা
- পাটিসাপটা
- দুধ চিতই
- তেলের পিঠা
- নকশি পিঠা
বিশেষ করে ভাপা পিঠা ও চিতই পিঠা খেজুরের গুড় বা দুধ দিয়ে পরিবেশন করা হয়, যা শীতের সকালে পটুয়াখালীর মানুষের প্রিয় নাস্তা। মিষ্টান্নের মধ্যে নারকেল নাড়ু, চিতই পিঠার দুধঝোল ও গুড়ের সন্দেশ ঘরে ঘরে তৈরি হয়।
চরাঞ্চলের বিশেষ খাদ্যাভ্যাস
পটুয়াখালী জেলার চরাঞ্চল—যেমন রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া ও গলাচিপার কিছু অংশ—এখানকার খাবারের ধরনে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
চরাঞ্চলের মানুষ সাধারণত সহজ, পুষ্টিকর ও দীর্ঘস্থায়ী খাবার পছন্দ করে।
চরাঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার—
- শুকনো মাছ ও ভর্তা
- ভাতের সঙ্গে ডাল ও শাক
- মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রান্না
- নারকেল ও কচু দিয়ে তরকারি
নদী ও সাগরনির্ভর জীবনযাত্রার কারণে এখানকার খাবার স্বাস্থ্যসম্মত ও প্রাকৃতিক উপাদানে ভরপুর।
পটুয়াখালীর খাবারের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
পটুয়াখালী জেলার খাবার কেবল পেট ভরানোর মাধ্যম নয়; এটি আতিথেয়তা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। অতিথি আপ্যায়নে ভালো মাছ, ভাত ও দই পরিবেশন এখানকার সামাজিক শিষ্টাচারের অংশ। বিশেষ করে—
- ইলিশ মাছ
- ভৈষা দই
- ঘরোয়া রান্না
এসব খাবার পটুয়াখালীর মানুষের আন্তরিকতা ও অতিথিপরায়ণতার প্রতীক।

পটুয়াখালী জেলার খাবার তার ভৌগোলিক অবস্থান, নদী-সাগরঘেরা প্রকৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইলিশ, শুঁটকি, পিঠা-পুলি ও ভৈষা দই—এসব খাবার শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। এই খাবারগুলো পটুয়াখালীর মানুষকে যেমন পরিচিত করেছে, তেমনি জেলার সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করেছে।