পটুয়াখালী জেলার পটভূমি

পটুয়াখালী জেলার পটভূমি দক্ষিণ বাংলার প্রাচীন ইতিহাস, নদীমাতৃক সভ্যতা, উপকূলীয় জীবনধারা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এই অঞ্চলের ইতিহাস শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বহিরাগত আক্রমণ, জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর এবং মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথায় সমৃদ্ধ।

পটুয়াখালী জেলার পটভূমি

 

প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য ও পটুয়াখালী

পটুয়াখালী জেলা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে—

  • চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের প্রথম রাজধানী ছিল বাউফল উপজেলার কচুয়া এলাকায়
  • নদী ও খালের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এই অঞ্চলকে বাণিজ্য ও নৌ যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে—

  • ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ
  • এবং পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের লাগাতার আক্রমণ

রাজধানী রক্ষাকে কঠিন করে তোলে। ফলে নিরাপত্তার স্বার্থে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজধানী বরিশালের মাধবপাশায় স্থানান্তর করা হয়। এই স্থানান্তরের মধ্য দিয়েই পটুয়াখালী অঞ্চলের রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেলেও জনপদের ইতিহাস থেমে থাকেনি।

পটুয়াখালী জেলার পটভূমি

 

মুঘল শাসনামল ও ভূমি জরিপ

মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলার প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস শুরু হয়। এই সময়—

  • সম্রাট আকবরের প্রখ্যাত মন্ত্রী রাজা টোডরমল
  • ১৫৯৯ সালে কানুনগা জিম্মক খানকে এই অঞ্চল জরিপের দায়িত্ব দেন

জরিপকালে দেখা যায়—

  • চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের বিশাল বনভূমি ও জলাভূমি আলাদা প্রশাসনিক গুরুত্ব বহন করছে
  • তখন বনাঞ্চলকে চন্দ্রদ্বীপ থেকে পৃথক করে “বাজুহাদবা” নামে একটি সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়

পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য—

  • সেলিমাবাদ
  • বাজুগ উমেদপুর
  • উরানপুর

এই তিনটি পরগনা নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত হয়। এই বিভাজন পটুয়াখালীর ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করে।

রাখাইন জনগোষ্ঠীর আগমন ও বসতি বিস্তার

পটুয়াখালী জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে রাখাইন জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আরাকানের বৌদ্ধ রাখাইনরা বর্মী রাজার নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়
  • প্রাণ রক্ষার্থে তারা বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এলাকায় পাড়ি জমায়

রাখাইনরা বসতি স্থাপন করে—

  • গলাচিপা উপজেলা
  • কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা ও খেপুপাড়া
  • রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে

তাদের আগমনের ফলে—

  • জনবসতি বৃদ্ধি পায়
  • কৃষি, মৎস্য ও লবণ উৎপাদনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়
  • গড়ে ওঠে স্বতন্ত্র রাখাইন সংস্কৃতি, ভাষা ও স্থাপত্য ঐতিহ্য

আজও কুয়াকাটা রাখাইন পল্লী পটুয়াখালীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে।

মুক্তিযুদ্ধ ও পটুয়াখালীর আত্মত্যাগ

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী জেলার ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল ও রক্তাক্ত।

  • ২৬ এপ্রিল ১৯৭১
    পাক হানাদার বাহিনী প্রথম পটুয়াখালী শহরে আক্রমণ চালায়
  • শহরের—

    • মাতবর বাড়ি

    • পুরান বাজার

    • ডিসি বাসভবন সংলগ্ন এলাকা
      সহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়

এই দিনে—

  • শতাধিক নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে শহীদ হন
  • পটুয়াখালী শহর রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে

পরবর্তীতে—

  • পটুয়াখালী সদর
  • গলাচিপা
  • কলাপাড়া
  • বাউফল সহ বিভিন্ন উপজেলায় সংঘটিত হয় একাধিক খণ্ড যুদ্ধ

এই যুদ্ধে পটুয়াখালীর অসংখ্য সূর্যসন্তান জীবন উৎসর্গ করেন

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলা হানাদার মুক্ত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করে।

পটুয়াখালী জেলার পটভূমি

পটুয়াখালী জেলার পটভূমি একদিকে যেমন প্রাচীন রাজ্য চন্দ্রদ্বীপের ঐতিহ্য বহন করে, তেমনি অন্যদিকে বহন করে উপকূলীয় সংগ্রাম, রাখাইন জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা। এই জেলা কেবল একটি প্রশাসনিক অঞ্চল নয়—এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মত্যাগের এক জীবন্ত দলিল।

Leave a Comment