আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র। পটুয়াখালী জেলা বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় জেলা। পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা নির্দেশ করে না; বরং এর মাধ্যমে জেলার ইতিহাস, প্রশাসনিক বিকাশ, নদ-নদী, উপকূলীয় অবস্থান ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র
গুগল ম্যাপে পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র দেখাতে এখানে ক্লিক করুন
পটুয়াখালী জেলার মানচিত্রের অবস্থান
বাংলাদেশের মানচিত্রে পটুয়াখালী জেলার অবস্থান দেশের দক্ষিণাঞ্চলে, বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূলে। মানচিত্র অনুযায়ী—
- উত্তরে: বরিশাল জেলা
- দক্ষিণে: বঙ্গোপসাগর
- পূর্বে: ভোলা জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী
- পশ্চিমে: বরগুনা জেলা
এই অবস্থান পটুয়াখালীকে একটি উপকূলীয় ও নদীবিধৌত জেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

মানচিত্রে ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন
পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক অবস্থান—
- উত্তর অক্ষাংশ: প্রায় ২২°১৯´
- পূর্ব দ্রাঘিমাংশ: প্রায় ৯০°১৯´
মানচিত্র অনুযায়ী জেলার মোট আয়তন প্রায় ৩,২২১.৩১ বর্গ কিলোমিটার। এর একটি বড় অংশ নদী, চর ও জলাভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত, যা মানচিত্রে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।
মানচিত্রে প্রশাসনিক কাঠামো
বর্তমান প্রশাসনিক মানচিত্রে পটুয়াখালী জেলা গঠিত—
-
৮টি উপজেলা
- পটুয়াখালী সদর
- বাউফল
- দুমকী
- দশমিনা
- গলাচিপা
- কলাপাড়া
- মির্জাগঞ্জ
- রাঙ্গাবালী
-
৫টি পৌরসভা
-
৭৬টি ইউনিয়ন
-
৪টি জাতীয় সংসদীয় আসন
মানচিত্রে প্রতিটি উপজেলা নদী ও সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত।

মানচিত্রে নদ-নদীর গুরুত্ব
পটুয়াখালী জেলার মানচিত্রে দেখা যায় অসংখ্য নদী ও শাখা নদী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- লোহালিয়া নদী
- পায়রা নদী
- তেঁতুলিয়া নদী
- আন্ধারমানিক নদী
- আগুনমুখা নদী
এই নদীগুলো জেলার মানচিত্রকে করেছে জটিল কিন্তু প্রাণবন্ত। নদীভিত্তিক মানচিত্র পটুয়াখালীর কৃষি, মৎস্য, নৌ-যোগাযোগ ও জনবসতির ধরণ ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
মানচিত্রে উপকূল ও চরাঞ্চল
মানচিত্র অনুযায়ী জেলার দক্ষিণাংশে বিস্তৃত—
- চর মোন্তাজ
- সোনারচর
- তুফানিয়ার চর
- কলাগাছিয়া চর
এই চরাঞ্চলগুলো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল, যা মানচিত্রে নিয়মিত হালনাগাদের প্রয়োজন তৈরি করে।
ঐতিহাসিক মানচিত্রের সূচনা
১৮০৭ সালে বরিশালের জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন মিঃ বেটি। দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন কেটে বসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর শাসন আমলেই ১৮১২ সালে পটুয়াখালীকে নিয়ে মির্জাগঞ্জ থানা গঠন করা হয়। এ সময়ের মানচিত্রে অঞ্চলটি মূলত বন ও নদী অধ্যুষিত ছিল।
১৮১৭ সালে প্রশাসনিক প্রয়োজনে স্থাপন করা হয়—
- বাউফল
- কাউখালী
- মেহেন্দিগঞ্জ
- কোটের হাট
এই চারটি মুন্সেফী চৌকি, যা পরবর্তীতে জেলার প্রশাসনিক মানচিত্রের ভিত্তি গড়ে তোলে।
ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে পটুয়াখালী
পটুয়াখালী জেলার মানচিত্রগত ইতিহাস মূলত ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। ১৯শ শতকের প্রথম ভাগে প্রণীত মানচিত্রগুলোতে বর্তমান পটুয়াখালী এলাকা মূলত বনভূমি, জলাভূমি ও নদীঘেরা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সে সময় এই অঞ্চলের মানচিত্রে বসতি খুবই সীমিত ছিল এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণভাবে নদীকেন্দ্রিক।
১৮০৭ সালে বরিশালের জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মিঃ বেটি দায়িত্ব গ্রহণের পর দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন কেটে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলেই ১৮১২ সালে পটুয়াখালীকে কেন্দ্র করে মির্জাগঞ্জ থানা গঠিত হয়, যা তৎকালীন মানচিত্রে একটি নতুন প্রশাসনিক চিহ্ন হিসেবে যুক্ত হয়।
মুন্সেফী চৌকি ও প্রশাসনিক মানচিত্র
১৮১৭ সালে দেওয়ানি শাসন বিস্তারের লক্ষ্যে বরিশাল অঞ্চলে পৃথক চারটি মুন্সেফী চৌকি স্থাপন করা হয়—
- বাউফল
- কাউখালী
- মেহেন্দিগঞ্জ
- কোটের হাট
এই চৌকিগুলো ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে বিচারিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। বিশেষ করে বাউফল চৌকি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রথম মুন্সেফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্রজমোহন দত্ত।
লাউকাঠীতে চৌকি স্থানান্তর ও মানচিত্র পরিবর্তন
১৮৬০ সালের ১ জুন বাউফল থেকে মুন্সেফী চৌকি স্থানান্তর করা হয় লাউকাঠীতে। এই স্থানান্তরের ফলে পটুয়াখালী অঞ্চলের মানচিত্রে একটি বড় পরিবর্তন ঘটে। লাউকাঠী তখন ছিল ঘন অরণ্যঘেরা এলাকা, যা নদী ও খালের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল।
লাউকাঠীর দক্ষিণ পাড়ে গভীর অরণ্যের মধ্যে একদল কাপালিক এসে একটি কালিমন্দির স্থাপন করে। ডাকাতির কারণে স্থানটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত হয় ডাকাতিয়া কালিবাড়ি নামে। এই স্থাপনাটি পরবর্তীতে মানচিত্রে একটি পরিচিত ভৌগোলিক নির্দেশক হয়ে ওঠে।
পটুয়াখালী মহকুমার সৃষ্টি ও মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তি
ব্রজমোহন দত্তই প্রথম পটুয়াখালীকে নতুন মহকুমা করার প্রস্তাব দেন। এর ফলস্বরূপ—
- ১৮৬৭ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা গেজেটে পটুয়াখালী মহকুমা সৃষ্টির ঘোষণা প্রকাশিত হয়
- ১৮৭১ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে মহকুমায় রূপান্তরিত হয়
এই সময় থেকে পটুয়াখালী নামটি ব্রিটিশ শাসনামলের প্রশাসনিক মানচিত্রে স্থায়ীভাবে স্থান পায়।
কালিকাপুর ও শহর গঠনের মানচিত্র
জমিদার হৃদয় শংকরের পুত্র কালিকা প্রসাদ রায়ের নামানুসারে লাউকাঠীর দক্ষিণ পাড়ের নামকরণ করা হয় কালিকাপুর। এখানেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে পটুয়াখালী শহর।
মানচিত্র অনুযায়ী—
- মহকুমা সদর অফিস স্থাপিত হয় কালীবাড়ি পুকুরের পূর্ব পাড়ে
- প্রথম দিকে বাঁশ ও ছনের ঘরে আদালত বসত, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল “বাউশশা কোর্ট” নামে
এই স্থানগুলো তৎকালীন মানচিত্রে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
জেলা হিসেবে পটুয়াখালীর আত্মপ্রকাশ
এক শতাব্দীর বেশি সময় মহকুমা হিসেবে থাকার পর—
- ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি – পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়
- ৯ মার্চ ১৯৬৯ – তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে পটুয়াখালী জেলার উদ্বোধন করেন
পটুয়াখালীর প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন হাবিবুল ইসলাম। এই সময়ের মানচিত্রে পটুয়াখালীকে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে দেখানো হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রশাসনিক মানচিত্র
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পটুয়াখালী জেলার মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন আসে। পাকিস্তান আমল থেকেই পটুয়াখালী বৃহত্তর বরিশাল জেলার অংশ হিসেবে খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্বাধীনতার পরও একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই অবস্থান বজায় থাকে।
পরবর্তীতে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সরকার বিভাগ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায়—
-
১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি – বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি—এই ছয়টি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের পঞ্চম বিভাগ ‘বরিশাল বিভাগ’ গঠিত হয়
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পটুয়াখালী জেলার মানচিত্রে একটি নতুন বিভাগীয় পরিচয় যুক্ত হয়।
আধুনিক পটুয়াখালী জেলার মানচিত্রগত কাঠামো
বর্তমান মানচিত্র অনুযায়ী পটুয়াখালী জেলা—
- আয়তন: ৩,২২১.৩১ বর্গ কিলোমিটার
- উপজেলা সংখ্যা: ৮টি
- পৌরসভা: ৫টি
- ইউনিয়ন: ৭৬টি
- সংসদীয় আসন: ৪টি
উপজেলাভিত্তিক মানচিত্র
পটুয়াখালী জেলার আধুনিক মানচিত্রে যে ৮টি উপজেলা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত রয়েছে—
- পটুয়াখালী সদর
- বাউফল
- দুমকী
- দশমিনা
- গলাচিপা
- কলাপাড়া
- মির্জাগঞ্জ
- রাঙ্গাবালী
প্রতিটি উপজেলাই নদী, খাল ও চরাঞ্চল দ্বারা প্রভাবিত—যা মানচিত্রে জেলার জলাভূমিনির্ভর ভূপ্রকৃতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
নদী ও উপকূলভিত্তিক মানচিত্রের গুরুত্ব
পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র মূলত নদীনির্ভর ও উপকূলীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। উল্লেখযোগ্য নদ-নদীগুলো—
- লোহালিয়া
- পায়রা
- আন্ধারমানিক
- তেঁতুলিয়া
- আগুনমুখা
এই নদীগুলো জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, কৃষি, মৎস্য ও বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানচিত্রে এসব নদী জেলার প্রাকৃতিক সীমানা ও পরিবহন ব্যবস্থার প্রধান নির্দেশক।
কৌশলগত অবস্থান ও অর্থনৈতিক মানচিত্র
আধুনিক মানচিত্রে পটুয়াখালী জেলার কৌশলগত গুরুত্ব বহুগুণে বেড়েছে—
- পায়রা সমুদ্র বন্দর
- পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
- কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
এই স্থাপনাগুলো পটুয়াখালীকে শুধু পর্যটন নয়, বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে তুলেছে।
বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী অবস্থান জেলার মানচিত্রকে দিয়েছে—
- সামুদ্রিক বাণিজ্য সুবিধা
- উপকূলীয় প্রতিরক্ষা গুরুত্ব
- ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা
পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র শুধু একটি ভৌগোলিক চিত্র নয়—এটি ইতিহাস, সংগ্রাম, প্রশাসনিক বিবর্তন ও উন্নয়নের দলিল। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তী আধুনিক বাংলাদেশ—প্রতিটি ধাপেই পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র নতুন পরিচয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে।