পটুয়াখালী জেলার ভৌগলিক পরিচিতি

পটুয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় জেলা, যা বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত। ভৌগোলিক অবস্থান, নদ-নদী, সাগরসংলগ্ন চরাঞ্চল ও বদ্বীপভূমির কারণে এ জেলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অন্যান্য জেলার তুলনায় স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময়।

পটুয়াখালী জেলার ভৌগলিক পরিচিতি

 

Table of Contents

পটুয়াখালী জেলার ভৌগলিক পরিচিতি

 

১. ভৌগোলিক অবস্থান

পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক অবস্থান—

  • অক্ষাংশ: ২২°১৯’৬০” উত্তর
  • দ্রাঘিমাংশ: ৯০°১৯’৬০” পূর্ব

এই অবস্থানের কারণে পটুয়াখালী জেলা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর অন্তর্গত এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত, নদীর জোয়ার-ভাটা ও সাগরের প্রভাব এখানে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান।

২. আয়তন

পটুয়াখালী জেলার মোট আয়তন—

  • ৩,২২১.৩১ বর্গ কিলোমিটার

এ আয়তনের একটি বড় অংশ নদী, খাল-বিল, চর ও নিম্নভূমি দ্বারা গঠিত। মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় জেলাটি উর্বর পলল ভূমির জন্য পরিচিত, যা কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

৩. সীমানা

পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক সীমানা নিম্নরূপ—

  • উত্তরে: বরিশাল জেলা
  • দক্ষিণে: বরগুনা জেলা ও বঙ্গোপসাগর
  • পূর্বে: ভোলা জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী
  • পশ্চিমে: বরগুনা জেলা

দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ থাকায় পটুয়াখালী জেলা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এই সাগরসংলগ্ন অবস্থান জেলার অর্থনীতি, জীবিকা, জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

৪. নদী ও বদ্বীপভূমি

পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক গঠনে নদ-নদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • লোহালিয়া
  • পায়রা
  • আন্ধারমানিক
  • তেঁতুলিয়া
  • আগুনমুখা

এই নদীগুলো বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে এবং জোয়ার-ভাটার প্রভাবে চর সৃষ্টি, ভূমি ভাঙন ও ভূমি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে।

৫. জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ (সংক্ষেপ)

পটুয়াখালী জেলার জলবায়ু—

  • উষ্ণ ও আর্দ্র
  • বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত
  • শীতকালে তুলনামূলক শুষ্ক
  • ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকা

এই ভৌগোলিক বাস্তবতা জেলার কৃষি, মৎস্য ও বসতবিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

পটুয়াখালী জেলার ভৌগলিক পরিচিতি

 

৬. প্রাচীন ভৌগোলিক অবস্থা ও জনবসতির সূচনা

বর্তমান পটুয়াখালী জেলা প্রাচীনকালে ছিল বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, নদীখাল ও জলাভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত এক বদ্বীপ অঞ্চল। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, এ এলাকা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নদী ও বনভূমির আধিক্যের কারণে প্রাথমিকভাবে এখানে স্থায়ী জনবসতি ছিল সীমিত।

বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় এবং নদীপথ সহজলভ্য থাকায় এই অঞ্চল ধীরে ধীরে নৌ-বাণিজ্য ও নদীবন্দরের গুরুত্ব লাভ করে।

৭. ব্রিটিশ আমলে ভৌগোলিক পরিবর্তন ও প্রশাসনিক বিকাশ

১৮০৭–১৮১৭ সময়কাল

১৮০৭ সালে বরিশালের জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মিঃ বেটি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার শাসনামলেই দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ভৌগোলিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায়—

  • ১৮১২ সালে পটুয়াখালীকে অন্তর্ভুক্ত করে গঠন করা হয় মির্জাগঞ্জ থানা
  • ১৮১৭ সালে বরিশালে স্থাপন করা হয় চারটি মুন্সেফী চৌকি—
    • বাউফল
    • কাউখালী
    • মেহেন্দিগঞ্জ
    • কোটের হাট

বাউফল চৌকির প্রথম মুন্সেফ ছিলেন ব্রজমোহন দত্ত, যিনি পরবর্তীতে পটুয়াখালীর প্রশাসনিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

৮. লাউকাঠী ও কালিকাপুর: শহর বিকাশের ভৌগোলিক কেন্দ্র

১৮৬০ সালের পরিবর্তন

  • ১৮৬০ সালের ১ জুন বাউফল থেকে মুন্সেফী চৌকি স্থানান্তর করা হয় লাউকাঠীতে
  • লাউকাঠীর দক্ষিণ পাড় তখন ছিল গভীর অরণ্যে আচ্ছাদিত
  • এই বনাঞ্চলে একসময় কাপালিক সম্প্রদায় বসতি গড়ে তোলে এবং স্থাপন করে কালিমন্দির
  • ডাকাতির জন্য এলাকাটি পরিচিতি পায় ডাকাতিয়া কালিবাড়ি নামে

পরবর্তীতে জমিদার হৃদয় শংকরের পুত্র কালিকা প্রসাদ রায়–এর নামানুসারে লাউকাঠীর দক্ষিণ পাড়ের নামকরণ করা হয় কালিকাপুর। এখানেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বর্তমান পটুয়াখালী শহর।

৯. পটুয়াখালী মহকুমা থেকে জেলা

  • ১৮৬৭ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা গেজেটে পটুয়াখালী মহকুমা সৃষ্টির ঘোষণা প্রকাশিত হয়
  • ১৮৭১ সালে পটুয়াখালী আনুষ্ঠানিকভাবে মহকুমায় রূপান্তরিত হয়
  • মহকুমা সদর অফিস স্থাপন করা হয় কালীবাড়ি পুকুরের পূর্ব পাড়ে

প্রথমদিকে বাঁশ ও ছনের তৈরি ঘরে আদালত বসত, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল “বাউশশা কোর্ট” নামে।

১০. জেলা হিসেবে পটুয়াখালীর আত্মপ্রকাশ

দীর্ঘ এক শতাব্দী পর—

  • ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি – খুলনা বিভাগের তৎকালীন কমিশনার এ. এম. এফ. পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন
  • ১৯৬৯ সালের ৯ মার্চ – তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে পটুয়াখালী জেলা উদ্বোধন করেন
  • পটুয়াখালীর প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন হাবিবুল ইসলাম

 

১১. বিভাগীয় পুনর্বিন্যাস ও ভৌগোলিক প্রশাসন

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর—

  • পূর্বে বরিশাল ও পটুয়াখালী উভয়ই ছিল খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত
  • ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে—
    • বরগুনা
    • বরিশাল
    • পটুয়াখালী
    • ভোলা
    • পিরোজপুর
    • ঝালকাঠি

এই ছয় জেলা নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশের পঞ্চম বিভাগ—বরিশাল বিভাগ।

১২. উপকূলীয় ভূপ্রকৃতি ও বদ্বীপ অঞ্চল

পটুয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বদ্বীপ এলাকা। জেলার দক্ষিণাংশ সরাসরি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় এটি সমুদ্র–প্রভাবিত ভূপ্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত।

এ অঞ্চলের ভূমি গঠিত হয়েছে মূলত—

  • নদীবাহিত পলল
  • চর ও দ্বীপাঞ্চল
  • জোয়ার–ভাটা প্রভাবিত জলাভূমি

বিশেষ করে রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া ও গলাচিপা উপজেলার দক্ষিণাংশে নতুন চর সৃষ্টি ও ভাঙনের প্রক্রিয়া আজও চলমান।

১৩. নদীনির্ভর ভৌগোলিক ব্যবস্থা

পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক কাঠামো গঠনে নদীসমূহের ভূমিকা অপরিসীম। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রধান নদীগুলো হলো—

  • লোহালিয়া
  • পায়রা
  • তেঁতুলিয়া
  • আন্ধারমানিক
  • আগুনমুখা

এই নদীগুলো—

  • কৃষিতে পলিমাটি সরবরাহ করে
  • নৌ-যোগাযোগ সহজ করে
  • মৎস্যসম্পদের আধার হিসেবে কাজ করে

নদীগুলোর মোহনায় বিশেষ করে ইলিশ মাছের প্রজনন ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে, যা জেলার অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে।

১৪. চরাঞ্চল ও দ্বীপভিত্তিক ভূগঠন

পটুয়াখালীর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হলো বিস্তৃত চরাঞ্চল। যেমন—

  • চর মোন্তাজ
  • চর কাজল
  • তুফানিয়ার চর
  • সোনারচর
  • কলাগাছিয়া চর

এই চরাঞ্চলগুলোতে—

  • নতুন ভূমি সৃষ্টি হচ্ছে
  • কৃষি ও বসতির সম্প্রসারণ ঘটছে
  • একই সঙ্গে নদীভাঙনের ঝুঁকিও বিদ্যমান

চরভিত্তিক জনজীবন পটুয়াখালীর ভূগোলকে করেছে বৈচিত্র্যময় ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ।

১৫. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভূগোলগত ঝুঁকি

পটুয়াখালী জেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। বিশেষত—

  • ঘূর্ণিঝড়
  • জলোচ্ছ্বাস
  • নদীভাঙন
  • লবণাক্ততা বৃদ্ধি

ইতিহাসে—

  • ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়
  • ১৯৯১, ২০০৭ (সিডর), ২০০৯ (আইলা)।

এই দুর্যোগগুলো পটুয়াখালীর ভৌগোলিক ও মানবিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

১৬. দুর্যোগ মোকাবিলায় ভৌগোলিক অভিযোজন

দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় পটুয়াখালী জেলায় গড়ে উঠেছে—

  • উপকূলীয় বাঁধ ও পোল্ডার ব্যবস্থা
  • শতাধিক সাইক্লোন শেল্টার
  • উঁচু মাচা ও আশ্রয়কেন্দ্র
  • লবণসহিষ্ণু ফসল চাষ

এই অভিযোজন কৌশলগুলো জেলার ভৌগোলিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

১৭. ভৌগোলিক গুরুত্ব ও কৌশলগত অবস্থান

পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক গুরুত্ব বহুমাত্রিক—

  • দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার
  • তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রা বন্দরের অবস্থান
  • কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র
  • নৌ ও স্থল যোগাযোগের সংযোগস্থল

ভবিষ্যতে এই জেলার ভূগোল—

  • বাণিজ্য
  • শিল্প
  • পর্যটন
  • জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত

উন্নয়নে কৌশলগত ভূমিকা পালন করবে।

পটুয়াখালী জেলার ভৌগোলিক পরিচিতি শুধু মানচিত্রগত সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি নদী, সমুদ্র, চর, দুর্যোগ ও মানব অভিযোজনের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সম্ভাবনাময় ভূখণ্ড।

Leave a Comment