পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস

পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস দক্ষিণ বাংলার জনপদ, নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা ও উপকূলীয় জীবনধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। পটুয়াখালী শহরের বয়স আনুমানিক দেড়শ বছরের বেশি হলেও এই অঞ্চলের মানব বসতি ও ইতিহাস তারও বহু প্রাচীন। তবে “পটুয়াখালী” নামটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে একাধিক মত, এবং এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো লিখিত দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 

পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস

 

পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

সপ্তদশ শতাব্দীতে বাকলা–চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চল, পর্তুগীজ জলদস্যুদের ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়। সে সময়—

  • লুণ্ঠন
  • অগ্নিসংযোগ
  • নারী নির্যাতন
  • অপহরণ
  • ধ্বংসযজ্ঞ

এর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, সে সময় বর্তমান পটুয়াখালী শহর এলাকা ছিল মূলত সুন্দরবন ও জলাভূমি, আর লোকালয় গড়ে উঠেছিল নদীর উত্তর পাড়ে।

 

পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস

 

পতুয়ার খাল তত্ত্ব (সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত)

পটুয়াখালী নামকরণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল আলোচিত ব্যাখ্যাটি এসেছে স্বর্গীয় দেবেন্দ্র নাথ দত্তের একটি পুরোনো কবিতার সূত্র ধরে। এই মত অনুযায়ী—

  • বর্তমান লাউকাঠী নদী একসময় ছিল
    লোহালিয়া ও পায়রা নদীর সংযোগকারী একটি ভাড়ানী খাল
  • এই খাল দিয়েই পর্তুগীজ জলদস্যুরা নৌপথে এসে গ্রামেগঞ্জে হামলা চালাত
  • স্থানীয় মানুষ ভয় ও আতঙ্কের কারণে এই খালকে ঘিরে নানা কেচ্ছা ও কল্পকাহিনি রচনা করে
  • ধীরে ধীরে এই খালটি মানুষের মুখে মুখে পরিচিত হয়ে ওঠে
    “পতুয়ার খাল” নামে

পরবর্তীকালে সময়ের পরিবর্তনে ও উচ্চারণের বিবর্তনের ফলে “পতুয়ার খাল” → “পটুয়াখালী” নামে রূপান্তর ঘটে বলে অধিকাংশ গবেষক মনে করেন।

১৯৮০ সালে শেরেবাংলা টাউন হলে অনুষ্ঠিত ‘পটুয়াখালী জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক সেমিনারে এই মতকে সমর্থন করেন—

  • অধিকাংশ প্রবন্ধকার
  • ইতিহাসবিদ
  • এবং ‘বরিশালের ইতিহাস’-এর প্রণেতা সিরাজ উদ্দিন আহমেদ

এ কারণে এই তত্ত্বটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।

পটুয়া সম্প্রদায় তত্ত্ব

নামকরণের আরেকটি মত অনুযায়ী—

  • একসময় এ অঞ্চলে পটুয়া সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল
  • তারা নিপুণ হাতে মৃৎপাত্র তৈরি করত
  • সেই পাত্রে আঁকা হতো নানা ধরনের পটচিত্র
  • এই “পটুয়া” শব্দ থেকেই “পটুয়াখালী” নামের উৎপত্তি হতে পারে

যদিও এ মতটি সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও, এর পক্ষে কোনো শক্ত ঐতিহাসিক বা দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি

পেটুয়াখালী বা পেট-আকৃতির খাল তত্ত্ব

আরেকটি মত অনুসারে—

  • এলাকাটি একসময় পেট-আকৃতির খাল দ্বারা বেষ্টিত ছিল
  • সেখান থেকেই নাম হতে পারে “পেটুয়াখালী”
  • যা পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে “পটুয়াখালী” হয়

তবে এই মতটিও গবেষকদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, কারণ এর পক্ষে ভৌগোলিক বা ঐতিহাসিক কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই

নামকরণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

পটুয়াখালী নামটি শুধু একটি ভৌগোলিক পরিচয় নয়; এটি—

  • উপকূলীয় ইতিহাসের সাক্ষ্য
  • নদীকেন্দ্রিক জনপদের প্রতিচ্ছবি
  • জলদস্যু–বাণিজ্য–নৌপথ নির্ভর যুগের স্মারক

এই নামের মধ্য দিয়েই পটুয়াখালীর ভয়, সংগ্রাম, নদী, প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস প্রতিফলিত হয়

সার্বিকভাবে বলা যায়, পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস বহুমাত্রিক ও রহস্যঘেরা। যদিও একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে, তথাপি ঐতিহাসিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞ মতামতের আলোকে “পতুয়ার খাল” থেকে পটুয়াখালী নামের উৎপত্তি তত্ত্বটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। নদী ও উপকূলীয় ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এই নাম পটুয়াখালীর অতীত ঐতিহ্য ও ভৌগোলিক বাস্তবতাকে আজও বহন করে চলেছে।

Leave a Comment