আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পটুয়াখালী জেলার নদ-নদী। পটুয়াখালী জেলা বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় জেলা। নদ-নদীই এই জেলার প্রাণ। অসংখ্য নদী, খাল ও শাখানদীর মাধ্যমে পটুয়াখালী জেলার প্রতিটি উপজেলা পরস্পরের সঙ্গে এবং বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত।
এই নদীগুলো শুধু ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যই নয়, বরং জেলার কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
পটুয়াখালী জেলার নদ-নদী

পটুয়াখালী জেলার নদীব্যবস্থা:
পটুয়াখালী জেলার প্রত্যেকটি উপজেলার মধ্য দিয়েই বয়ে গেছে একাধিক নদী। এসব নদী মূলত—
- গঙ্গা–পদ্মা–মেঘনা নদী ব্যবস্থার অংশ,
- এবং শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
এই জেলার নদীগুলো অধিকাংশই জোয়ার-ভাটাপ্রবণ এবং উপকূলীয় চর সৃষ্টি ও ক্ষয়প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

লাউকাঠি নদী
লাউকাঠি নদী পটুয়াখালী শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি স্থানীয় যোগাযোগ, নৌ-বাণিজ্য ও শহরের জলনিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একসময় এই নদী পটুয়াখালী শহরের বাণিজ্যিক বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
লোহালিয়া নদী
লোহালিয়া নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী।
- দৈর্ঘ্য: ৯৩ কিলোমিটার
- গড় প্রস্থ: ৩২৫ মিটার
- নদীর প্রকৃতি: সর্পিলাকার
- পাউবো পরিচিতি নম্বর: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৮৪
এই নদীটি কৃষি সেচ, নৌযান চলাচল এবং মৎস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। লোহালিয়া নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকা অনেকাংশে এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।
আন্ধারমানিক নদী
আন্ধারমানিক নদী পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় নদী।
- দৈর্ঘ্য: ২৯ কিলোমিটার
- গড় প্রস্থ: ৫০০ মিটার
- পাউবো পরিচিতি নম্বর: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৪
- নদী ব্যবস্থা: গঙ্গা–পদ্মা সিস্টেম
এই নদী উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার প্রভাবে প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এবং ইলিশসহ নানা সামুদ্রিক মাছের বিচরণক্ষেত্র।
পায়রাগঞ্জ নদী
পায়রাগঞ্জ নদী পটুয়াখালী জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখানদী। এটি স্থানীয় নৌ-চলাচল, কৃষিকাজ এবং গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখে।
তেতুলিয়া নদী
তেতুলিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী এবং পটুয়াখালী জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর একটি।
- দৈর্ঘ্য: ৫৬ কিলোমিটার
- প্রস্থ: ৪৫ মিটার
- গভীরতা: ৫.৫ মিটার
- নদী অববাহিকার আয়তন: ৬৩ বর্গকিলোমিটার
তেতুলিয়া নদীর বৈশিষ্ট্য:
- পানিপ্রবাহ মৌসুমি প্রকৃতির
- ডিসেম্বর–মার্চে শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ থাকে না
- বর্ষায় (জুলাই মাসে) পানিপ্রবাহ বেড়ে ৭৮০ ঘনসেন্টিমিটার/সেকেন্ড হয়
- জোয়ার-ভাটার প্রভাব নেই
- সাধারণত বড় ধরনের বন্যা হয় না
এই নদীর ওপর ফুলবাড়ি ও বুনিয়াতপুর এলাকায় ৩টি সেতু রয়েছে, যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাঙ্গাশিয়া নদী
পাঙ্গাশিয়া নদী পটুয়াখালী জেলার একটি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি আশপাশের কৃষিজমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে এবং মৎস্য সম্পদে অবদান রাখে।
আগুনমুখা নদী
আগুনমুখা নদী পটুয়াখালী জেলার একটি উল্লেখযোগ্য নদী।
-
দৈর্ঘ্য: ১৫ কিলোমিটার
এই নদীটি মূলত উপকূলীয় এলাকায় পানি নিষ্কাশন, মাছ ধরা ও নৌযোগাযোগে ব্যবহৃত হয়।
নদ-নদীর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব
পটুয়াখালী জেলার নদ-নদীগুলো—
- কৃষি সেচের প্রধান উৎস
- ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের প্রজনন ক্ষেত্র
- নৌপথে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যম
- চর সৃষ্টি ও উপকূলীয় ভূমি গঠনে সহায়ক
-
স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার ভিত্তি
একই সঙ্গে এসব নদী প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার ঝুঁকিও বহন করে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, পটুয়াখালী জেলার নদ-নদী শুধু ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং জেলার অর্থনীতি, কৃষি, মৎস্য, সংস্কৃতি ও মানব বসতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পটুয়াখালীর জনপদ ও সভ্যতা। নদী সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এই জেলা আরও সমৃদ্ধ ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।